Site icon স্যাট একাডেমী ব্লগ

বাংলাদেশের নদ-নদী এবং জানা অজানা

নদী ও বাংলাদেশ একই সূতোয় গাঁথা দুটি নাম। এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দেশে সর্বত্র জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নদীগুলো। বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ, যার সৃষ্টি নদীবাহিত পলি জমাট বেঁধে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে এসব নদীতে মিশেছে। এসব নদ-নদী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বৈচিত্র্য দান করেছে। বলতে গেলে এ নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। সে জন্যই নদীর সাথে বাঙালির রয়েছে নাড়ীর টান।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে অসংখ্য নদনদীর মধ্যে অনেকগুলো আকার এবং গুরুত্বে বিশাল। এসব নদীকে বড় নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।বৃহৎ নদী হিসেবে কয়েকটিকে উল্লেখ করা যায় এমন নদীসমূহ হচ্ছে: পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলি, শীতলক্ষ্যা, গোমতী ইত্যাদি।

পদ্মা:

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী পদ্মা। এর দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কি.মি.। এটি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মধ্যদিয়ে গঙ্গানদী পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পদ্মা নদী রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার দৌলদিয়ায় যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। এছাড়া চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। কুমার, গড়াই, ভৈরব, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, চিত্রা ইত্যাদি পদ্মার প্রধান শাখা নদী। পদ্মার উপনদীগুলো হলো মহানন্দা, নাগর নদী, পুনর্ভবা, টাঙ্গন এবং কুলিখ।

মেঘনা:

ভারতের মনিপুর রাজ্যের নাগা মনিপুর পাহাড়ের পাদদেশে মেঘনা নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তি স্থলে এর নাম বরাক। বরাক নদীটি বাংলাদেশের অদূরে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানার ভিতর দিয়ে পৃথকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কালনী হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে। এরপর চাঁদপুরে পদ্মার সাথে মিলিত হয়ে আরও দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মনু, খোয়াই মেঘনার প্রধান শাখা নদী এবং গোমতী, তিতাস, ডাকাতিয়া মেঘনার উপনদী।

ব্রহ্মপুত্র:

এ নদ হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে তিব্বতের উপর দিয়ে পূর্ব দিকে ও পরে আসামের ভিতর দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। অতঃপর ব্রহ্মপুত্র কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা ও তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের প্রধান উপনদী এবং বংশী ও শীতলক্ষ্যা প্রধান শাখা নদী।

যমুনা:

যমুনা নদী তিব্বতের কৈলাশ শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্রের শাখা যমুনা নদী নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে দৌলতদিয়ার কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। করতোয়া ও আত্রাই যমুনার প্রধান উপনদী। যমুনার শাখা নদী ধলেশ্বরী আর ধলেশ্বরীর শাখা নদী বুড়ি গঙ্গা।

নদী ও কৃষি:

কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের চাষাবাদ ব্যবস্থা অনেকটাই নদীর সেচ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কেননা আমন ধান কাটার পর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজতলা তৈরি করে ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে বোরো ধান রোপণ করা হয়। এ সময় বোরো মৌসুমে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না বিধায় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত জোয়ারের সময় নদীর পানি দিয়ে সেচ প্রদান করা হয়। এজন্য কৃষির উন্নয়নে নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নদী ও শিল্প:

বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলো বিভিন্নভাবে নদীর পানি ব্যবহার করে। এছাড়া নদী পথে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় বড় শিল্প কারখানা নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে।

মৎস্য সম্পদ:

নদীমাতৃক এ দেশটি স্মরণাতীতকাল থেকে মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধশালী। আর তাইতো বাঙালিকে বলা হত ‘মাছে ভাতে বাঙালি।’ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মৎস্যখাত ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ছিল ৫.৫২ শতাংশ। বাংলাদেশে নদীতে ইলিশ, পাঙাশ, রুই, কাতলা, বোয়াল, পাবদাসহ বিভিন্ন ধরণের মাছ পাওয়া যায়।

নৌ চলাচল ও পরিবহন:

নদী পরিবহন সবচেয়ে সস্তা ও সহজ পরিবহন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে নদী পরিবহন দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে ২টি প্রধান সমুদ্রবন্দর রয়েছে চট্টগ্রাম ও মংলায়। ইওডঞঈ দেশের ৬০০০ কি.মি নৌপথে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে থাকে। নদী পথে পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার প্রভৃতি পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জল বিদ্যুৎ উৎপাদন:

বাংলাদেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্ণফুলী নদীতে অবস্থিত যা কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে পরিচিত। খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে ১৯৬২ সালে স্থাপিত এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৫টি ইউনিটের মাধ্যমে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। এ কেন্দ্রটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সামান্য হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

নদী ও যোগাযোগ ব্যবস্থা:

নদী পথে সুলভে যাতায়াত করা যায়। বাংলাদেশে সারাবছর নৌ চলাচল উপযোগী নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫২২১ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৪৩৯ কিলোমিটার। বাংলাদেশে বর্তমানে ২২টি নদী বন্দর রয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ প্রধান নদীবন্দর যেটি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। এছাড়া অসংখ্য নদীর উপর রয়েছে সুদৃশ্য সেতু। যেমন বঙ্গবন্ধু সেতু যা যমুনা নদীর উপর অবস্থিত। এটি বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম সেতু। তাছাড়া নির্মিতব্য পদ্মা সেতু তৈরি হলে এটি হবে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সেতু যার দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি.মি.। এছাড়া খানজাহান আলী সেতু, লালনশাহ সেতু উল্লেখযোগ্য।

নদী ও বাংলা সাহিত্য:

নদীকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি। সুদূর ফ্রান্সে বসে মাইকেল মধুসূধন দত্ত লিখেছেন-
সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
বহু দেশ দেখিয়াছি, বহু নদজলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে
নদীকে কেন্দ্র করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছেন ‘কর্ণফুলী’। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মাবোটে বসে লিখেছিলেন ‘সোনার তরী’ নামক বিখ্যাত কবিতাটি। তাছাড়া নদীর কথা আসতেই এই গানটি মনে পড়ে যায়-

ও নদীরে একটা কথা সুধাই শুধু তোমারে. . .
কোথায় তোমার দেশ তোমার নাইকি চলার শেষ।

নদীর নামকরনঃ

বাংলাদেশের সবগুলো নদীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্ত্তত করা বেশ কঠিন। নদীর নামকরণের ক্ষেত্রে এদেশে কোনো ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। এখানে একই নদীকে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকার প্রবণতা রয়েছে। এমনকি কোনো একটি নদীর মাত্র পাঁচ/ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অংশকেও এর উজানের নামের থেকে ভিন্ন নামে ডাকা হয়। নদীটির নতুন নামকরণ কোনো স্থান থেকে শুরু হলো তা নির্ধারণ করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। আবার একই নামে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নদীর অস্তিত্ব রয়েছে। বিশেষত দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের নদীগুলো এতবেশি শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত যে ভিন্ন ভিন্ন শাখা-প্রশাখাগুলোকে আলাদা নামে চিহ্নিত করা সব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

নদী অববাহিকতার ধাপঃ

প্রথাগতভাবে নদীকে পূর্ণতার ধাপ অনুসারে ‘যৌবন’, ‘পরিণত’ এবং ‘বার্ধক্য’ – এ তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে। যৌবন অবস্থায় নদীকে খাড়াপার্শ্ববিশিষ্ট উপত্যকা, খাড়া ঢাল এবং অসম তলদেশ দ্বারা শনাক্ত করা যায়। নদীর মধ্যগতিতে বা পরিণত অবস্থায় প্রশস্ত নদী উপত্যকা, প্রশস্ত নদীপাড়, উপনদীসমূহ দ্বারা অগ্রসরমাণ সম্মুখ ক্ষয়কার্য এবং সুষম নদীতলদেশ প্রভৃতি ভূমিরূপ পরিলক্ষিত হয়। বার্ধক্য অবস্থায় নদী ভিত্তি সমতলে উপনীত হয় এবং প্রশস্ত সমতল অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদীই বার্ধক্য পর্যায়ে পৌঁছে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

নদী আমাদের জন্য আশীর্বাদঃ

নদীপথে যাতায়াত সুবিধা এবং নদী উপত্যকাসমূহের পলিমাটি উৎকৃষ্ট কৃষিভূমি হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতাসমূহ নদী উপত্যকায় গড়ে উঠেছে। নাব্য নদ-নদীসমূহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নগর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রধান শহর, নগর ও বাণিজ্যকেন্দ্রসমূহ বিভিন্ন নদীর তীরে গড়ে উঠেছে; যেমন- বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা মহানগরী, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দর, কর্ণফুলি নদীর তীরে চট্টগ্রাম, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ময়মনসিংহ শহর গড়ে উঠেছে। পর্যাপ্ত প্রবাহ, গতিবেগ এবং নতিমাত্রাবিশিষ্ট নদী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কাপ্তাই নামক স্থানে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।