Site icon স্যাট একাডেমী ব্লগ

বিজ্ঞান সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কী বলে?

ইতিহাসের এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে কোরআন নাজিলের মাস রমজান। শত শঙ্কা, উৎকণ্ঠা আর আশা-নিরাশার দুর্বিপাকে মুমিন মুসলমানরা নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ আর সংযম নিয়ে ব্রত রয়েছে কোরআনিক জীবনাচারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।

কোরআনুল কারিম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিযা। আর মহান আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি; বরং তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য, অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখানোর জন্য এ কোরআন দিয়েই সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। কারণ মহাগ্রন্থ আল কোরআন এক শাশ্বত গ্রন্থ। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এই যুগে মানুষ তার মধ্য থেকে নতুন নতুন অনেক তত্ত্ব ও উপাত্ত আবিষ্কার করছে। শিল্প-সাহিত্য, সামাজিক নীতি-আদর্শ, সমরনীতি, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা, যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব, সব কিছুই রয়েছে এ কোরআনের মধ্যে। পবিত্র কোরআনই সব মানব হিতৈষী জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার বা মৌলিক সূত্র। কিন্তু আমরা যারা শুধুমাত্র ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে কোরআন অধ্যয়ন করি তাদের কাছে পবিত্র কোরআনের সেই জ্ঞানভাণ্ডার কখনোই উন্মোচিত হয় না। তবে কোরআনে বর্ণিত উলুল-আলবাব বা গভীর জ্ঞানের অধিকারীগণই পবিত্র কোরআনের সেই বিজ্ঞানময় বাণীসমূহের প্রকৃত অর্থ অনুধাবনে সক্ষম।

আর তাই কোরআন নাজিলের এই পবিত্র মাসে এই মহাগ্রন্থের বিস্ময়কর কতিপয় বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

কোরআন নাজিলের সময় বিজ্ঞান

কোরআন নাজিলের বহু শতাব্দী পর উদ্ভাবিত আজকের নানা বিষয়ক বিজ্ঞান তখন ছিল না। মহাবিশ্ব, জীববিজ্ঞান, বায়ুমণ্ডলের গঠন—এর কোনো কিছু সম্পর্কেই ধারণা ছিল না তৎকালীন বিশ্বের। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে নানা কুসংস্কার আর প্রাচীন উপকথায় বিশ্বাসী ছিল মানুষ।

অথচ সেই সময়ে নাজিল হওয়া এই বিস্ময়কর গ্রন্থে আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে রিলেটেড আয়াতই রয়েছে সহস্রাধিক। যার একটি আয়াতকেও আধুনিক বিজ্ঞান মিথ্যা বা অনর্থক প্রমাণ করতে পারেনি। বরং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নানা সূত্র ভুল প্রমাণিত হয়ে তা যুগে যুগে কোরআনের মাপকাঠিতে সংশোধিত হয়েছে। এমনি কিছু বিস্ময়কর তথ্য নিয়ে আমাদের আজকের গ্রন্থনা।

মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতা বর্ণনায় কোরআন

মহাকাশবিজ্ঞানীগণ বহুকাল পর্যন্ত এ ধারণা পোষণ করছিলেন যে, মহাবিশ্ব স্থির রয়েছে। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে বিজ্ঞানীগণ সেই ধারণা থেকে ফিরে এসে বলেন যে, মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে সুষমভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে, অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলো একটা থেকে আরেকটা দূরে সরে যাচ্ছে। এবং পদার্থবিজ্ঞানীগণ মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণের সমর্থনে বহু বাস্তব থিওরি পেশ করেছেন, যা অস্বীকার করার মতো নয়। ১৯৪৯ সালের ২৯ মার্চ বিবিসি সংবাদে এ নিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। [সূত্র মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া : মহাবিস্ফোরণ তথ্য] অথচ পবিত্র কোরআন তাদের এই আবিষ্কারের বহু পূর্বে নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে এই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ তথ্যটি জানিয়ে দিয়েছে। আলাহ তাআলা বলেন : আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আকাশ সৃষ্টি করেছি এবং নিশ্চয়ই আমি একে সম্প্রসারিত করেছি। (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৪৭) কোরআনের এই বর্ণনাটি শত শত বছর গবেষণার পর বিজ্ঞানীদের অর্জন করা চূড়ান্ত রায়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

পরাগায়ণ রীতি

পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ শুধু মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে রয়েছে। আর উদ্ভিদগুলো জড় পদার্থের মতো, তাতে কোনো লিঙ্গান্তকরণ নেই। এটিই ছিল সাধারণ জনতার বিশ্বাস। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান নানা প্রযুক্তির মাধ্যমে আবিষ্কার করেছে যে, গাছপালা ও তরুলতার ফুল ও ফল হয় পরাগায়ণের মাধ্যমে, অর্থাৎ সেখানের রয়েছে জোড়া জোড়া (পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ)। অথচ এই অভিনব বৈজ্ঞানিক তথ্যটির কথা কোরআন তার ভাষায় ঘোষণা করেছে—‘পবিত্র তিনি যিনি জোড়া সৃষ্টি করেছেন প্রত্যেকটা জিনিসকে এমনকি জমিন যা উৎপন্ন করে, তাদের (মানুষ) নিজেদেরকে এবং তারা যা জানে না তাও তিনি জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা ইয়াসীন, আয়াত : ৩৬)। ‘তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ৩)

মাতৃদুগ্ধ

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন যে ‘মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর বুকের দুধ পান করাবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৩)। এই আদেশের যেমন রয়েছে সন্তানের উপকার তেমনি রয়েছে মায়েদের বহুবিধ কল্যাণ। আর আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, মায়ের দুধের বিকল্প নেই। এই দুধের মধ্যে সন্তানের প্রয়োজনীয় সব কিছুই রয়েছে। মায়ের দুধ যে শুধু স্বাস্থ্য পুষ্টি ও শিশুর নিরাপত্তা বিধানেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে তা নয়। উপরন্তু মায়ের দুধ শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ও শিক্ষা গ্রহণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে যে মায়েরা সন্তানদের বুকের দুধ পান করান তাদের জরায়ু খুব তাড়াতাড়ি গর্ভধারণের পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে, স্তন ক্যান্সারের আশঙ্কা হ্রাস পায়। মায়ের দুধের তাপমাত্রা থাকে শরীরের জন্য যথোপযুক্ত ও সহজেই হজম হয়। মায়ের দুধ সন্তানের রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

বৈদ্যুতিক বাল্ব

আল্লাহ আসমান ও জমিনসমূহের নূর, তাঁর নূরের উপমা যেন একটি দীপাধার, যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো,… আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তেল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; …আল্লাহ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করে থাকেন এবং আল্লাহ সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ। (সুরা নূর, আয়াত : ৩৫) একটু ভেবে দেখবেন? কিসের উপমা দেখছেন এই আয়াতে? এটা কি আধুনিক বৈদ্যুতিক বাল্ব নয়? যার তেল হচ্ছে ইলেকট্রন কণা। যা প্রজ্বলনের সময় অগ্নিশিখা ছড়িয়ে যায় না। দেড় হাজার বছর আগে মানুষ কল্পনা করতে পেরেছিল এই বাল্বের কথা? কিন্তু কোরআর তার ভাষায় বর্ণনা দিয়ে রেখেছিল। আমাদের বুঝতে এতটা সময় লেগে গেছে।

অত্যাধুনিক যানযন্ত্র

পবিত্র কোরআন দেড় হাজার বছর আগে ঘোষণা করেছে—‘তোমাদের জন্য নৌকার অনুরূপ যানবাহন তৈরি করব, যাতে তারা ভবিষ্যতে আরোহণ করবে।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ৪২) অন্য আয়াতে বলেন, ‘তিনি তোমাদের আরোহণের জন্য এবং শোভার জন্য সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, গাধা, খচ্চর। আর তিনি আরো জিনিস তৈরি করবেন, যা তোমরা জানো না।’ (সুরা নাহাল, আয়াত : ৮) প্রিয় পাঠক! একটু ভাবুন, নৌকার অনুরূপ যান কি জাহাজ নয়? আর ভবিষ্যৎ যান বলতে কি বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ আর নবধারায় সৃষ্ট বাহনগুলো নয়?

ম্যাটার সায়েন্স বা ইন্টারনেট প্রযুক্তি

কয়েক দশক পূর্বেও কি মানুষ ভাবতে পারত ই-মেইল, ফ্যাক্স বা সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে চোখের পলকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলোর গতিতে কোনো কিছুকে পাঠিয়ে দিতে পারবে? কিন্তু ম্যাটার সায়েন্সের কল্যাণে আজকের পৃথিবী রীতিমতো এর ব্যবহার করছে। কোনো বস্তুকে রূপান্তর করে আলোর গতিতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার টেকনোলজিকে বলা হয় ম্যাটার সায়েন্স। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, চৌদ্দ শত বছর আগেই কোরআন এ বিষয়েও তার বাণী পেশ করে রেখেছে—‘কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, ‘আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা আপনাকে এনে দেব।’ অতঃপর সুুলাইমান যখন তা সামনে স্থির অবস্থায় দেখলেন তখন তিনি বললেন, ‘এ আমার রবের অনুগ্রহ…’। (সুরা নামল, আয়াত : ৪০)

মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং থিওরি

বিগ ব্যাং হলো ইংরেজি শব্দ, যার অর্থ হলো বিকট শব্দ। এই বিগ ব্যাং থিওরির মূল কথা হলো, আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে সৌরজগতে একদিন হঠাৎ নক্ষত্রে নক্ষত্রে সংঘর্ষ হয়, এতে একটি বিকট শব্দ হয়। এই বিকট শব্দের মাধ্যমে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া গ্রহ নক্ষত্রের টুকরো থেকেই এই পৃথিবীর সৃষ্টি। স্টিফেন হকিংয়ের বিগ ব্যাং থিওরি আজ সর্বমহলে স্বীকৃত। এ থিওরি মতে মহাবিশ্বের সকল দৃশ্য-অদৃশ্য গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টির শুরুতে একবিন্দুতে পুঞ্জীভূত ছিল। অতঃপর একটা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এরা চারদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে। ঠিক একই কথা দেড় হাজার বছর আগের কোরআণ তার ভাষায় বলছে—‘যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে তারা কি দেখে না যে আসমানসমূহ ও জমিন মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে, তারপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং প্রাণবান সব কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে; তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩০) আয়াতটি আমাদেরকে একেবারে পরিষ্কারভাবে বলছে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রেরা একসময় এক জায়গায় পুঞ্জীভূত ছিল।

ড. মিলার বলেছেন, দেড় হাজার বছর আগে ইসলামের নবীর পক্ষে কিভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য নিয়ে কথা বলা সম্ভব? কারণ এটি এমন এক বৈজ্ঞানিক বিষয় যা সম্পর্কে তথ্য আবিষ্কার করে মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এক বিজ্ঞানী। মিলারের মতে এই আয়াতে সেই বিগ ব্যাং এর কথাই বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে পৃথিবী, আকাশমণ্ডলী ও তারকারাজি সৃষ্টি হয়েছে। এই বিগ ব্যাং থিওরির সিদ্ধান্ত হলো ‘অনবরত দূরে সরে যাওয়া গ্রহ নক্ষত্রগুলো একসময় আবার কাছাকাছি আসা শুরু করবে এবং সময়ের ব্যাবধানে সব একত্রে মিলিত হয়ে একটা পিণ্ডে পরিণত হবে।’ আর কোরআন বলে রেখেছে, ‘সেই দিন আকাশমণ্ডলীকে গুটিয়ে ফেলব, যেভাবে গুটানো হয় লিখিত দফতর’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৪) কি কিছু অনুধাবন করতে পারছেন? সেই গুটিয়ে ফেলার অর্থ কী? এই হলো বিস্ময়কর মহাগ্রন্থ আল কোরআন!

পৃথিবীর গোল আর ডিম্ব দ্বন্দ্ব

প্রায় পাঁচ শ বছর আগে ১৫৫৭ সালে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী গোলাকার। এতকাল সেই ধারণাই লালন করেছে আধুনিক বিশ্ব। কিন্তু মহাশূন্যে রকেট পাঠানোর পর পাল্টে গেছে এ বিশ্বাস। আবিষ্কৃত হয় যে, পৃথিবী আসলে ঠিক গোলাকার নয়, বরং অনেকটা উপবৃত্তকার অর্থাৎ পাখির ডিমের মতো। চলুন দেখা যাক পৃথিবীর আকৃতি সম্বন্ধে বিস্ময় গ্রন্থ কোরআন কী বলছে— ‘আর পৃথিবী, তিনি উহাকে তৈরি করলেন ডিম্বাকৃতির ন্যায়।’ (সুরা নাজিয়াত, আয়াত : ৩০) এই আয়াতে ডিম বুঝাতে দাহাহা ব্যবহার করা হয়েছে। যার বিশুদ্ধ অর্থ অস্ট্রিচের (উটপাখি) ডিম। আজ আমরা এটাও নিশ্চিতভাবে দেখতে পাই যে, পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি উটপাখির ডিমের আকৃতির সঙ্গে মিলে যায়। একজন উম্মি আরব ব্যক্তি কোনোরূপ প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়াই এত নিখুঁতভাবে পৃথিবীর আকৃতি বলে দিলেন দেড় হাজার বছর আগে। ভাবতে পারে সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে?

ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপ প্রযুক্তি  কোরআন

মাত্র শতাব্দীকাল পূর্বে ১৮৮০ সালে বিজ্ঞানী স্যার স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটন আবিষ্কার করে যে, প্রত্যেকের আঙুলের ছাপে ভিন্নতা রয়েছে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের আঙুলে ছাপ মিলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ পবিত্র কোরআনে দেড় হাজার বছর আগেই এ তথ্য ঘোষিত হয়ে আছে। যা আমাদের অনুধাবন করতে এত সময় লেগে গিয়েছে। কোরআনুল কারিমের সুরা কিয়ামাহ এর ৩ ও ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে—‘মানুষ কি মনে করে যে আমি তার অস্থিসমূহকে একত্রিত করতে পারব না? বস্তুত আমি উহাদের অঙ্গগুলোর অগ্রভাগ পর্যন্ত সুবিন্যস্ত করব।’ অর্থাৎ কারো আঙুলের অগ্রভাগই অন্য কারো সঙ্গে পুরোপুরি একই হবে না।

ব্ল্যাকহোল তথ্য

দেড় হাজার বছর আগে কোরআন ঘোষণা করেছে ‘আমি শপথ করছি সেই জায়গার যেখানে তারকারাজি পতিত হয়। নিশ্চয়ই এটা একটা মহাসত্য, যদি তোমরা তা জানতে।’ (সুরা ওয়াক্বিয়া, আয়াত : ৭৫, ৭৬) ৭৫ নং আয়াতটি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে, মহাবিশ্বে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে তারকা পতিত হয়। ঠিক পরের আয়াতেই এটাকে, মহাসত্য বলে দাবি করা হয়েছে। মহাকাশে এ রকম স্থান আছে, এটা মাত্র কিছুদিন আগে আবিষ্কার করা হয়েছে। এই জায়গাগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ব্ল্যাকহোলস। এগুলোতে শুধু নক্ষত্র নয়, যেকোনো কিছুই এর কাছাকাছি এলে, এখানে পতিত হতে বাধ্য।

মহাকাশ জয়

মানুষ আজ সাধনা গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে মহাকাশ জয় করেছে, প্রযুক্তির চরম উন্নতি সাধন করেছে। নভোচারীগণ চাঁদে পৌঁছেছেন, মানুষ যা কল্পনা করেছিল তা বাস্তবায়ন করছে, যেগুলো স্বপ্ন মনে করেছিল সেগুলো বর্তমানে স্বচক্ষে অবলোকন করছে। আবার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর নতুন নতুন তথ্য মানুষের নিকট ধরা পড়ছে। অজানা অচেনা অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করছে। তবু মানুষ বসে নেই। আরো জানার অদম্য আগ্রহ নিয়ে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে জিন ও মানবকুল নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের প্রান্ত অতিক্রম করার তোমরা যদি শক্তি রাখো তবে অতিক্রম করো, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি ব্যতীত তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।’ (সুরা রাহমান, আয়াত : ৩৩)

এ আয়াতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, আকাশ ও পৃথিবীর প্রান্ত অতিক্রম করতে হলে বিরাট শক্তি ও সামর্থ্য দরকার। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বোঝানো হয়েছে যে, জিন ও মানবজাতি উভয়ই শক্তি অর্জনের মাধ্যমে মহাকাশ জয়ে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। সেহেতু বাক্যটি শর্তযুক্ত নয় বরং খবর দেওয়া হয়েছে। আর জিন ও মানবকে সমপর্যায়ে রেখে বর্ণনা করেছে। এমন একসময় আসবে যা সেই সময় মানবজাতির কল্পনায়ও আসেনি যে মানবজাতি জিন জাতির ন্যায় পৃথিবী থেকে সৌরজগতে পদার্পণ করবে। কেননা কোরআন সেই মহান আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ। যিনি সার্বিকভাবে সব কিছুই অবগত আছেন যে, মানুষ জাতিও একদিন এমন কাজ করতে সক্ষম হবে। যেমন জিন জাতিরা করতে সক্ষম হয়েছে।

চন্দ্রালোক থিওরি

আমরা যে দিকেই তাকাই না কেন সর্বত্র মহান স্রষ্টার সৃষ্টিনৈপুণ্য আর সঠিক নিয়ম শৃঙ্খলা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। পৃথিবীতে বসে রাতের বেলা যদি আমরা চন্দ্রের দিকে নজর দিই তখন দেখতে পাই যে চন্দ্রের মৃদু আলোয় আলোকিত হচ্ছে এই পৃথিবী। বিজ্ঞান আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে চাঁদ একসময় জ্বলছিল। এরপর চন্দ্রের নিজের কোনো আলো নেই, অন্যের আলোতে আলোকিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মহান সেই আল্লাহ যিনি মহাশূন্যে সৌরজগৎসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে একটি আলোক এবং একটি আলোকপ্রাপ্ত চাঁদকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৬১)

পৃথিবীর ইতিহাসে বিস্ময়করভাবে আবিষ্কৃত সেই গ্রন্থটি আজ চৌদ্দ শ বছর পরেও প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আশ্চর্যজনক নির্ভুলতা ও সঠিকত্বে অতুলনীয়।

মানবভ্রূণের পেশি-হাড় গঠন

পবিত্র কোরআনে মাতৃগর্ভে মাংসপেশি গঠিত হওয়ার আগেই বাচ্চার হাড় গঠিত হওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে—‘এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তবিন্দুতে পরিণত করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে অতঃপর সেই পিণ্ডকে হাড়-এ আর এরপর সে হাড়কে মাংসপেশি দ্বারা সজ্জিত করি। এবং এরপর তাকে একটি নতুন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করি, আল্লাহ তাআলার আশীর্বাদ দ্বারা সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিরূপে। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা কত কল্যাণময়।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২-১৪)

আজকের আধুনিক বিজ্ঞান কিছুদিন আগেও এ ধারণা পোষণ করত যে, ভ্রূণের হাড় ও মাংসপেশি একই সময়ে তৈরি হয়। কিন্তু আজকের আধুনিক এমবায়লজি বলছে—‘সাত সপ্তাহের মধ্যে কঙ্কালের গঠন শেষ হয় এবং দেহের সবখানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এবং হাড়ের বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে। অষ্টম সপ্তাহের দিকে মাংসপেশি গঠিত হতে থাকে, যা হাড়ের চারপাশে অবস্থান নিতে থাকে।’

Keith Moore (developing Human, 6 part)-১৯৯৮ অর্থাৎ মানুষের জন্ম ঠিক সেভাবেই হয় যেভাবে কোরআনে বলা হয়েছে। মার্কিন নাগরিক ও বিজ্ঞানী মার্শাল জনসন ভ্রূণতত্ত্ব সম্পর্কিত আয়াত প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভ্রূণের বিকাশের পর্যায়গুলো সম্পর্কে কোরআনের বাস্তবমুখী ইনফরমেশনগুলোতে হতবাক না হয়ে উপায় নেই। কারণ দেড় হাজার বছর আগে মাইক্রোস্কোপের অস্তিত্ব ছিল না। কোরআন নাজিলের বহু বছর পরে যখন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হলো তখন ওই মাইক্রোস্কোপ কোনো বস্তুকে ১০ গুণের বেশি বড় করতে পারত না এবং এর স্বচ্ছতাও আজকের মাইক্রোস্কোপের মতো ছিল না। কাজেই কোরআনের এ বাণী কোনো মানুষের হতে পারে না।’

আসমানের সপ্তস্তর

আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, ট্রাপোস্ফিয়ার, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, ওজনোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার, থার্মোস্ফিয়ার, আয়ানোস্ফিয়ার, এক্সোস্ফিয়ার এইগুলো সব সাত আসমানের ভিন্ন ভিন্ন নাম। আমাদের মাথার ওপরের আকাশ সাতটি স্তরে বিভক্ত; এটি আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু মহাগ্রন্থ আল কোরআন দেড় হাজার বছর আগেই এই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে—‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন, যা কিছু যমিনে রয়েছে সেই সমস্ত, অতঃপর তিনি মনোযোগ দিয়েছেন আকাশের প্রতি। বস্তুত তিনি তৈরি করেছেন সাত আসমান। আল্লাহ সর্ববিষয়ে অবহিত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৯) বিংশ শতাব্দীর আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা ইহা বৈজ্ঞানিকভাবে যা প্রমাণিত হয়েছে। কোরআন দেড় হাজার বছর আগে এই সাতটি স্তরের কথাই এভাবে বলেছে রেখেছে! খুবই বিস্ময়কর।

জমিনের সপ্তস্তর

মহান আল্লাহ সুরা তারেক এর ১২ নং আয়াতে ঘোষণা করেন, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং পৃথিবী সেই একই পরিমাণে।’ আয়াতটি আমাদের বলছে শুধু আসমানই নয় বরং পৃথিবীরও সাতটি স্তর রয়েছে। প্রিয় পাঠক! ভাবতে পারেন; যখন মানুষ পৃথিবীর ব্যসার্ধ নির্ণয় প্রক্রিয়াই শেখেনি; তখন কোরআন বলে দিচ্ছে—জমিনের সাতটি স্তর রয়েছে। আর আজকের বিজ্ঞান প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে এর উপরিভাগ পর্যন্ত সাতটি স্তর রয়েছে। গঠনগত এবং কার্যগত দিক থেকে একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো মিলই নেই। এগুলো হলো 1. Crust, 2. Lithosphere, 3. Upper mantle, 4. Asrenosphere, 5. Lower mantle, 6. Outer core, 7. Inner core. (Robart Gardner, Samuel F, Allyn and Bacon, Newton, Howe : General science-1885, Page-319-322)

প্রিয় পাঠক! পবিত্র কোরআনের বিজ্ঞান সম্পৃক্ত আয়াতের পরিসংখ্যান এই ধরনের ক্ষুদ্র প্রবন্ধে পেশ করা আদৌ সম্ভব নয়। 

তথ্যসূএ ইন্টারনেট