মাকড়সাকে আমার ব্যাক্তিগত ভাবে রহস্যময় প্রাণী মনে হয়। বিবর্তনের ধাপে ধাপে সকল প্রাণীই বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেকে পরিবর্তন করে আসছে। মাকড়সাও থেমে নেই।
(ছবিসূত্র : Sticky Science: the Evolution of Spider Webs)
বিবর্তনীয় মতবাদ অনুসারে মাকড়সা যখন জল থেকে স্থলে এসে বসবাস করা শুরু করলো, সে তার আত্মরক্ষা এবং খাবার নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জাল বুনার মত একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবর্তন ঘটালো। সেটা হলো তার পেট থেকে সৃষ্টি হওয়া জাল। জাল বুনার জন্য কয়েকরকম গ্রন্থি রয়েছে, যা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের জাল নির্গত করে থাকে। তাদের মধ্যে প্রধান দুইরকম হল: সুরক্ষার জন্য তৈরি করা সুতা, আঠালো সুতা যা দ্বারা শিকার ধরা হয়। আরো কিছু মাকড়সা আছে যারা প্রায় আটধরনের ভিন্ন ভিন্ন সুতা উৎপাদন করতে পারে। সব সুতাই সিল্কের তৈরি। কিন্তু, মাকড়সা এই সিল্কের সুতা সহজে উৎপাদন করতে পারে না। এটা খুবই ব্যয় স্বাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ, এই সিল্ক উৎপন্ন হতে প্রয়োজন হয় প্রোটিনের। তাই মাকড়সা জাল পেতে যদি ঠিকমত শিকার ধরতে না পারে তাহলে পরিশ্রম বৃথা হয়ে যায়। যতই দিন যেতে থাকে মাকড়সার বুনা জালগুলো সক্ষমতা হারাতে থাকে মানে মেয়াদউত্তীর্ণ হয়ে যায়। সেটা মাকড়সার জন্য খুবই কষ্টের। তাই মাকড়সা কি করে নিজের বুনা জাল প্রতিদিন সে অল্প অল্প করে নিজে খেয়ে নেয় যাতে ব্যয়িত শক্তির সমতা রক্ষা হয়। এই জাল খেয়ে ফেলা একপ্রকার রিসাইকেল।
এই জাল গুলোর বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে:
•স্পাইরাল অর্ব বা গোলাকৃতির জাল
•জট পাকানো জাল
•ফানেল আকৃতির জাল
•নলাকৃতির জাল
•পাতা বা কাগজাকৃতির জাল
(ছবিসূত্র : Sticky Science: the Evolution of Spider Webs)
এই ভিন্ন প্রকার জাল ভিন্ন প্রকারের মাকড়সা দ্বারা তৈরি হয়ে থাকে।
মাকড়সা কিন্তু নিজের পাতা ফাঁদে অনেকসময় নিজেই আটকে যায়। সেজন্যই সে আঠাযুক্ত এবং আঠা ছাড়া উভয় প্রকার জালই বুনে থাকে। খুব সুনিপুণ ভাবে তারা তাদের জালের উপর হেঁটে বেড়ায়। যদি মাকড়সা ভাবে যে সে জালের উপর অবস্থান করবে তাহলে তার বুনা জালটি হবে আঠাছাড়া। এটা সে নিজের আত্মসম্মানবোধ থেকেই করে। যদি নিজের জালে নিজেই আটকে যায় তাহলে তা লজ্জার। আর যদি সে এটাকিং মুডে থাকে মানে শিকার ধরতেই হবে, তাহলে সে আঠাযুক্ত জাল বুনে জালের বাইরে অবস্থান করে। যদি শিকার ধরা পরে তাহলে সে তার জালের কোনো একটা রেখা, যেটা সে যাওয়া আসার উপযোগী করে বানিয়ে রাখে, সেটা ধরে শিকারের কাছে এগিয়ে যায়। মাকড়সার পা গুলোও এমন ভাবে বিবর্তিত হচ্ছে যাতে সে জালে জড়িয়ে না যায়।
এবার এই জালের পিছনে পদার্থবিদ্যা কি?
মাইক্রোস্কোপ এর নিচে যখন মাকড়সার তৈরি সিল্কের সুতাগুলো পরীক্ষা করা হলো, তখন দেখা গেলো সুতাতে কিছু আঠার বিন্দু রয়েছে। নিচের ছবিতে দেখুন। এগুলোই শিকারকে আটকে দেয়।
এই আঠার বল বা বিন্দুগুলো দ্বারাই শিকার ধরা নির্ধারিত হয়। খুব দ্রুত বেগে উড়ে আসা শিকারের জন্য সেগুলো রাবারের তৈরি জালের মত কাজ করে। প্রথমে শিকার এসে জোরে ধাক্কা খেলে প্রথমে সম্পূর্ণ জালটি পিছনের দিকে চলে যায়, মানে শিকারের গতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য, অন্যথায় জাল ছিড়ে যেতে পেরে। তারপর শিকার সুতাতে থাকা আঠায় আটকে যায়। যতই সে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে ততই জড়িয়ে পরে।
(ছবিসূত্র: Spider web fly trap vector image on VectorStock)
শিকার ধরার পিছনে স্থির তড়িতের ও কিছু ভূমিকা আছে। একটু মনে করে দেখুন আমরা স্কুলের বইতে রেশমি কাপড় বা সিল্কের তৈরি কাপড় দিয়ে স্থির তড়িতের কিছু পরীক্ষা নিয়ে জেনেছিলাম। মাকড়সার জালেও তো ওই একই সিল্ক রয়েছে। তার মানে মাকড়সার জালে কিছু চার্জ সঞ্চিত থাকে। অপরদিকে উড়ে আসা পতঙ্গের শরীরেও কিছু চার্জ বা আধান থাকে। ধরে নিলাম, রেশমী সুতাতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই রকমের আধানই বিদ্যমান। এখন যে পতঙ্গটি উড়ে জালের দিকে আসছে তার শরীরে ঋণাত্মক বা ধনাত্মক যেকোনো একটা আধানের পরিমাণ বেশি। যদি ধনাত্মক আধানের পরিমাণ বেশি হয় তবে তা জালে থাকা ঋণাত্মক আধান দ্বারা আকৃষ্ট হবে অথবা যদি ঋণাত্মক আধানের পরিমাণ বেশি থাকে তবে তা জালে থাকা ধনাত্মক আধান দ্বারা আকৃষ্ট হবে। কারণ, বিপরীতধর্মী আধান পরষ্পরকে আকর্ষণ করে।
মাকড়সার জাল বুননের উপর মহাকর্ষের ও প্রভাব রয়েছে। ১৯৭৩ সালে দুইটি ইউরোপিয়ান মহিলা গার্ডেন স্পাইডারের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। এই পরীক্ষার লক্ষ্য ছিলো মাকড়সা মহাশুন্যে ও ঠিক একইরকম ভাবে জাল বুনতে পারে নাকি তা পর্যবেক্ষণ করা। এই দুই মাকড়সার নাম ছিলো এরাবেলা এবং আনিতা। তারা রকেটে করে উড়ে গেলো মহাশুন্যের পরীক্ষাগারে। সেখানে মহাকাশচারী ওয়েন গ্যারিয়ট মাকড়সা গুলোকে একটা জানালা সম্বলিত বাক্সে পুরে তার মধ্যে ক্যামেরা লাগিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। উল্লেখ্য সেখানে অভিকর্ষ বলের প্রভাব ছিলো প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। এই দুইটি মাকড়সার মাথায় তারা যে ভরহীন অনুভব করছিলো সেটা মেনে নিতে একটু সময় নিয়েছিলো। তারপর তারা জাল বুনা শুরু করলো। পরীক্ষা শুরুর একদিন পর দেখাগেলো এনাবেলা প্রায় জালটি সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, কিন্তু কিছু অংশ অসম্পূর্ণ ছিলো। এর পরবর্তী দিনে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেলো জাল পুরোপুরি বুনা হয়ে গিয়েছে। এরপর তাদের খাবার হিসেবে দেয়া হলো একটু জল এবং একটি মাছি। এরপর তাদের আবার জাল বুনতে দেয়া হল। প্রথমে তারা জাল বুনতে অসমর্থ হলো। সেটা দেখে তাদেরকে আরো কিছু জল খাওয়ানো হল। এবার যে জালটি বুনলো তা পূর্বেরটার তুলনায় বড় ছিলো। তাদের বুনা জাল গুলো পরীক্ষা করে দেখা গেলো মহাশুন্যে বুনা জাল গুলো পৃথিবীতে বুনা জালের তুলনায় অনেক সুন্দর ছিলো এবং বৈশিষ্ট্যগত ভাবে ভিন্ন ও ছিলো। কিন্তু, কিছু ত্রুটি ছিলো, কয়েকজায়গায় তুলনামূলক মোটা ও কয়েকটা জায়গায় তুলনামূলকভাবে চিকন ছিলো যেখানে পৃথিবীতে বুনা জাল সব দিকে সমান ছিলো। ফলাফল হিসেবে দাড়ালো অভিকর্ষের ও একটা প্রভাব রয়েছে এই জাল বুনার উপর।
( পরীক্ষণটির একটি ভিডিও চিত্র)
মানুষ মাকড়সার এই আশ্চর্য সৃষ্টিকে প্রায় হাজার বছর আগে থেকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে আসছে। গ্রীকরা রক্তপাত বন্ধ করার জন্য মাকড়সার জাল ব্যাবহার করতো এবং কিছু কিছু আদিগোষ্ঠী এই জাল দিয়ে সুতা বানিয়ে ছোটো ছোটো মাছ ধরার বড়শি বানাতো। সোলোমন দ্বীপের আদিবাসীরা এখনো মাকড়সার জাল দিয়ে মাছ ধরে।
বর্তমান গবেষণা থেকে দেখা যায় এর থেকে অনেক শক্তিশালী কিছু তৈরি করা সম্ভব। এই গবেষণার ভালো দিক হলো এতে কোনো পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি নেই। মানুষ কেভলার নামম একপ্রকার সিল্ক কৃত্রিমভাবে তৈরি করছে, যা পরিবেশ দূষণ করছে। এর কারণে মানুষ চাইছে প্রাকৃতিকভাবে মাকড়সার জাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে কেভলার কে প্রতিস্থাপিত করতে।
যা যা বানানো সম্ভব :
• বুলেটপ্রুফ জামা
•পানিরোধী হালকা জামা
•প্যারাস্যুট
•পরিবেশবান্ধব বোতল
• সার্জিকেল ব্যান্ডেজ বা ট্যাপ
•এমনকি আমাদের শরীরে টেন্ডন ছিঁড়ে গেলে তা এই জাল দিয়ে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা চলছে।
তাহলে ভাবুন মাকড়সা কত উপকারী। মাকড়সার জাল দেখলে একটু ভাববেন এবং কত শিল্প লুকিয়ে আছে একটু পর্যবেক্ষণ করবেন।
তথ্যসূত্র: