আধুনিক মালেয়েশিয়ার জনক, সফলতার দৃষ্টান্ত

একটি দেশের উন্নয়নে সেই দেশের জনগণের অবদান যতটা থাকে, তার চাইতে দ্বিগুণ অবদান থাকে দেশটির শাসকের। শুধু একজন যোগ্য শাসকই পারেন একটি জাতির ইতিহাস সম্পূর্ণরুপে বদলে দিতে। এমনই একজন সুযোগ্য, দূরদর্শী ও সাহসী শাসক ছিলেন মাহাথির মুহাম্মদ। আসুন আজ জেনে নিই ৯১ বছর বয়সী মালয়েশিয়ার এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে কিছু অজানা কথা।

আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রুপকার ড. মাহাথির বিন মুহাম্মদ ছিলেন মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী। এককালের দরিদ্র মালয়েশিয়াকে বিশ্বের ১৪তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তিনি তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে আত্মনির্ভরশীল জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী নীতি ও অন্যায় আচরণগুলোর বিভিন্ন সময় অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তীব্র সমালোচনা করেছেন মাহাথির। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংহতি ও সম্প্রীতি স্থাপন করে দৃঢ় জাতীয় ঐক্য গঠনের যে অসাধারণ দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন তা সবার জন্য শিক্ষনীয়।

১৯২৫ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ অধ্যুষিত মালয়ের কেদাহ অঞ্চলের অ্যালোর সেতার নামক স্থানে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে মাহাথির জন্মগ্রহণ করেন। তার আগের প্রধানমন্ত্রীদের কেউ ছিলেন রাজপুত্র, কেউবা অভিজাত বংশীয়। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী। পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন মাহাথির। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতের কেরালার অধিবাসী। তার পিতা মুহাম্মদ বিন ইস্কান্দার ছিলেন মালয়ের একটি ইংলিশ স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক। পিতা তাকে ধন-সম্পদ দিতে পারেন নি, কিন্তু নিজের শৃঙ্খলা, একাগ্রতা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।

মাহাথির তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন মালয়ের সেবেরাং পেরেক স্কুলে। মালয়রা সংখ্যায় বেশি হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চায়নিজ ও ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুতরা তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলো। এ সময় মালয় বালকদের পক্ষে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হওয়াটা ছিলো দুঃসাধ্য বিষয়। কিন্তু জেদী মাহাথির এই কাজটিই করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে স্থান করে নেন। অ্যালোর সেতার-এর গভর্নমেন্ট ইংলিশ স্কুল, যা পরে সুলতান আবদুল হামিদ কলেজে পরিণত হয়, সেখানে ভর্তি হন মাহাথির। স্কুলে মাহাথির তার বহুমুখী সাফল্য দেখাতে শুরু করেন। অন্য ছাত্রদের তুলনায় তিনি ছিলেন আলাদা। ইংরেজি রচনা প্রতিযোগিতায় প্রতিবার পুরষ্কার জিতে নেওয়া তার জন্য সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়।

প্রাইমারী স্কুল থেকেই আয় করা শুরু করেন মাহাথির। তিনি দুই সেন্ট দিয়ে তিনটি করে বেলুন কিনে ক্লাসে তা বিক্রি করতেন প্রতিটি দুই সেন্ট দিয়ে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে জাপান মালয় দখল করে নেয়। এই সময়টাতে মাহাথিরের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি এক চায়নিজের সাথে ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তারপর তার দুজন বন্ধুর সাথে শুরু করেন কফির ব্যবসা। এক্ষেত্রেও তিনি তার স্বকীয়তা বজায় রাখেন। কোনো জাপানী সৈন্যের কাছে তিনি কফি বিক্রি না করে বরং স্থানীয় মার্কেটে ছাড়েন। ব্যবসা বড় করতে গিয়ে তিনি জাপানীদের কাছে বাধাগ্রস্ত হন।

ব্যবসা করতে এসে মাহাথির বুঝলেন, মালয়রা কেন এবং কীভাবে সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। মালয়ীদের মধ্যে ব্যবসায়ী খুঁজে পেলেন না তিনি। তাদের দুর্বলতাগুলো একের পর এক তার সামনে আসতে থাকলো। তার চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত আরও কিছু তরুণকে নিয়ে তিনি বয়সে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এরপর মাত্র ২০ বছর বয়সে ‘ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে’ যোগ দিয়ে মাহাথির তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন।

২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপানীরা পরাজিত হয়ে ফিরে গেলে মাহাথির ফিরে আসেন কলেজে। তিনি ঠিক বুঝতেন যে, সমাজে কিছু করতে হলে আগে প্রতিষ্ঠিত ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তাই ডাক্তার হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে তখন সেই মেডিকেলে মাত্র ৭ জন মালয়ী শিক্ষার্থী ছিলেন। এই ৭ জনের একজন ছিলেন সিতি হাসমাহ, যাকে পরবর্তীতে মাহাথির স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। এসময় মাহাথির বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। এসব লেখায় তিনি মালয় জাতির বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন।

বিয়ের এক বছর পরে মাহাথির নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। কিছুদিন সরকারী হাসপাতালে চাকরী করে পরে তা ছেড়ে দিয়ে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপন করেন। এটি ছিলো এ এলাকায় কোনো মালয়ী পরিচালিত প্রথম ক্লিনিক। এখানে কাজ করতে গিয়ে মালয়ীদের আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান তিনি। বিপুল সংখ্যক গরীব মালয়ীকে তিনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেন। তাদের বাড়িতে যান এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানেন। সাধারণ মানুষদের কাছাকাছি থাকার তার এই প্রবণতা প্রধানমন্ত্রী হবার পরেও থেকে যায়।

You may also like...

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.