জীবন গাথা স্মৃতি কথাঃ ড.মাহফুজুর রহমান

ড. মাহফুজুর রহমান :

১) ক্লাস ফাইভে পড়ি, পাশের বাড়ির আমার বয়েসি এক ছেলের সাথে ওর বিদেশী লেগো সেট নিয়ে খেলা করি। একদিন ওর সেটের একটা পার্টস খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ও খুঁজলাম। আমি ওর বাসা থেকে বের হবার সময় ওর মা আমার শার্ট প্যান্টের পকেট চেক করলো।

২) আমার এক কাজিন একটা দূর্দান্ত আই,বি,এম পিসি কিনলো। মানে ওর বাবা কিনে দিয়েছিলো। উনি তখন ইন্টার পড়তেন। সবাই কে দাওয়াত করে এনে কম্পিউটার দেখাচ্ছে। আমি ওই পিসি র মাউস টা একটু নাড়ানোর অপরাধে কষে থাপ্পড় খেলাম।

৩) কুরবানি ঈদের পরের দিন আমি বাড়িওয়ালার বাসায় দেখা করতে যাই। উনারা কথা বার্তা বললেন। আমি টেবিলে বসে আছি। পরিচারিকা পোলাও মাংস, কাবাব নিয়ে এলো। আমি হাত ধুতে বাথরুমে গেলাম। এসে দেখি কিছুই নেই। সে তাদের আত্মীয় কে খাবার দেবার পরিবর্তে ভুল করে আমাকে দিয়েছে। পরে সেমাই খেয়ে চলে এলাম।

৪) পাড়ার সবাই একটা রেস্টুরেন্ট এ খেতে গিয়েছি। এক ভাইয়ার বাবা গাড়ি কিনেছেন সেই সেলিব্রেশনে। আসার সময় দামী মাইক্রোবাস এ সবার যায়গা হলো। আমার হলো না। এক বড় ভাই বল্লো, তুমি একটা রিকশা করে চলে আসো। আমি গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। একটা মেয়ে ফিক করে হেসে ফেল্লো।

৫) আমার ক্যালকুলেটর নষ্ট, বন্ধু কে বললাম এক্সাম চলছে কলেজে, দুই/তিন দিনের জন্য ক্যালকুলেটর টা ধার দে। ওর ক্যালকুলেটর টা এক্সপেনসিভ। ও দিলো না। হেসে হেসে বল্লো, এইটা হারায়া ফেললে তোর আব্বাও এইটা কিনে দিতে পারবে না।

৬) স্কুল লাইফে একটা মেয়ে কে অনেক পছন্দ করতাম। তাকে বলার সাহস কখনো হয়নি। একদিন সাহস করে ওর বার্থডে তে একটা গোলাপ দিয়ে ওকে বললাম, হ্যাপি বার্থডে।
ওর গোলাপ টা ছুড়ে ফেলে আমাকে বল্লো, যেমন ফকিন্নি মার্কা চেহারা তেমন ফকিন্নি ছাত্র। এতো সাহস ক্যান তোমার!! পাশে ওর অনেক বান্ধবী ছিলো, সবাই হো হো করে হেসে ফেল্লো।

৭) ক্রিকেট ম্যাচ হবে। পাশের পাড়ার সাথে। চ্যালেঞ্জ ম্যাচ। আমি খুব ই এক্সাইটেড। আগের দিন ব্যাট মুছে রেডি করলাম। সকালে আমার মা আমাকে আদর করে দোয়া পড়ে দিলেন। মাঠে গিয়ে দেখি আমাদের টিমে ১৪ জন। আমি ওপেনিং বোলিং করবো। হালকা প্র্যাক্টিস করছি। ক্যাপ্টেন বড় ভাই ১১ জন সিলেক্ট করে দুই জন এক্সট্রা রাখলেন। আমি রিকশা করে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে এলাম। ১৪তম লোক টা আমি।

৮) নাইনে অংকে পেলাম ৩৯। ক্লাস টেনে রোল নাম্বার পিছিয়ে ৬০। আমার আত্মীয় স্বজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। একবার আমার মামার বাসায় বেড়াতে গেলাম। ক্লাস থ্রি তে পড়া মামাতো বোন আমার কাছে একটা অংক নিয়ে এলো। সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম। আমার মামী বল্লো, যাও সুমনের (আমার আরেক কাজিন) কাছে বুঝো। ও অংক বুঝে নাকি?
যথারীতি সবাই হেসে ফেল্লো।
ক্লাস থ্রি এর অংক ও আমি বুঝি না।!!

৯) ছোট্ট বেলায় খুব রোগা ছিলাম। দেখতেও ভালো ছিলাম না। একসাথে পাড়ার সব ছেলেরা যখন খেলতাম, কোনো সুন্দর মেয়ে আশেপাশে এলে অন্য রা আমাকে আব্দুল আব্দুল করে ডাকতো। একবার আমি শুনতে পেরেছিলাম একটা ছেলে বলছিলো, ওর নাম ও আব্দুল, দেখতে ও আব্দুলের মতো।

১০) কলেজ লাইফে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা আমার করার কথা, কিন্তু উপস্থাপিকা আমার সাথে উপস্থাপনা করতে চায় নি। কারন, আমি ওর লেভেলের স্মার্ট নই। আমাকে অনুষ্ঠানের দিন রিহার্সেল সত্ত্বেও দর্শক সারি তে বসতে হলো, যদিও বেশীক্ষণ থাকা লাগেনি, অন্য ছাত্র ছাত্রী র হাসাহাসির কারনে বাধ্য হয়ে বাসায় চলে এসেছিলাম।
এই ঘটনা গুলো প্রতি টা ই আমার সাথে ঘটা। আমি নিজের ব্যাপারে সত্যিই কনফিডেন্ট ছিলাম না। খুব কষ্ট হতো। মাঝে মাঝে মনে হতো মরে যাই না কেনো?

আমি বড়লোক নই, সুদর্শন নই, স্মার্ট নই, কথা বলতে পারি না, খারাপ ছাত্র। কি দরকার আমার পৃথিবী তে থাকার? অনেক সময় শিক্ষক দের বকা খেতাম, মার খেতাম। কিন্তু আমি বেচে রইলাম, মরতে ভয় হয়। আমি চেষ্টা করে গেলাম।
আমার ভালো কোনো গুন না থাকলে ও একটা শক্তি ছিলো। স্বপ্ন কে বাস্তবতার রূপ দেবার জন্য সাহস। একা একাই যুদ্ধ করেছি। পাশে পেয়েছি আমার মা আর বাবা কে। আমার উপর তাদের অনেক বিশ্বাস ছিলো।
মানুষের সব অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি নিজেকে পরিবর্তন করেছি। I always forgive, but never forget.

জীবন গাথা, স্মৃতি কথা ড. মাহফুজুর রুহমান
জীবন গাথা, স্মৃতি কথা ড. মাহফুজুর রুহমান

আমার জীবন টা খুব সহজ সুন্দর ছিলো না। আমাকে জীবনে অনেক অনেক ধাক্কা খেতে হয়েছে। আর আমি শিখেছি – “জীবনে তোমার সব চেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু তুমি নিজেই।”

চোখের পানি কেউ মুছে দেয় না, নিজেকেই মুছতে হয়। ঘুরে দাঁড়াতে হয়। যখন কোনো আশা থাকেনা, আশা তৈরী করে নিতে হয়। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে চলে যাবার পর ও সেখানে যাবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় মাথা উচু করে সবার মাঝে নিজেকে আলোকিত করতে।

আমি কষ্ট করেছি, সবাই যখন আনন্দ করতো, আমি তখন পারতাম না। কিন্তু একদিন পেরেছি। এবং সেই জয়ের তৃপ্তি যে কত খানি, আমি জানি।

আজ আমাকে যে কোনো প্রোগ্রামে সন্মান করা হয়। আমাকে লজ্জা পেতে হয় না। মোটামুটি সফল একজন প্রকৌশলী বলা চলে।
আমার যে পরিমান লেগো সেট আছে, অনেকেই ঈর্ষান্বিত হবে। আমি যে কম্পিউটার ব্যবহার করি ওই ভ্যালু তে সাধারন মানের দশ টা কম্পিউটার কেনা যাবে। অনেক অনেক ইলেকট্রনিক গেজেট আমি কিনি। অপচয় হয়তো, কিন্তু তৃপ্তি পাই।
প্রতি টা লজ্জার, চড়ের, লাঞ্ছনার হিসাব আদায় করি।

অসুন্দর বলে অনেক অপমানিত হয়েছি, এখন হইনা বরং সবাই বেশ হ্যান্ডসাম ই বলে কথা না বলতে পেরেও এখন ভালো বক্তা। আনস্মার্ট হয়েও এখন অফিসে স্মার্টনেসের রেফারেন্স।

ঘুরে দাঁড়ানো খুব কষ্টের কিছু না। প্রয়োজন শুধু সাহস আর দমের। বুকে দম থাকলে হারতে চাইলেও হারা যায় না। আর আশা, সুন্দর একটা স্বপ্ন। যা পূরন করা একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে।

Don’t expect help…. help yourself. আমি যখন ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তিন টা ওষুধ, আমার কাজে লেগেছিলো…
Self motivation
Self Confidence
Self Coaching

পরিশেষে এটাই বলবো আমার কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা না করে নীজেদের নিয়ে চিন্তা করো তবেই সাফল্য ধরা দিবে।
ধন্যবাদ। 

You may also like...

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.