ব্যর্থতা জিন্দাবাদ – শাহরুখ খান
প্রেরণামূলক ভাষণ ব্যর্থতা জিন্দাবাদ – শাহরুখ খান
শাহরুখ খান জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা। ১৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি এই বক্তৃতা দেন।
শুভ সন্ধ্যা! আজকে এখানে আসার সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। আজকে আমি তোমাদের আমার জীবনের সবচেয়ে সরল কথাগুলো বলে যাব। জানি না আমার কথায় তোমরা অনুপ্রাণিত হবে কি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, এই সহজ সত্যগুলো তোমাদের টিকে থাকতে সাহায্য করবে।
জীবনকে অনেকভাবেই মাপা যায়; বয়স, সময় কিংবা লক্ষ্য দিয়ে বোঝানো যায় জীবনের পথচলা। সময়ের পরিমাপ আমাকে প্রায়ই বিভ্রান্ত করে। যেদিন আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন, সেই একটি দিন আমার কাছে সারা শৈশবের চেয়েও দীর্ঘ মনে হয়। আমার জীবনের গন্তব্য কোথায়, মনে হয় না এই প্রশ্নের উত্তর আমি কখনো জানতাম। আমি হেঁটেছি, প্রাণপণে দৌড়েছি আমার স্বপ্নের পথে, যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু এসেছে, সবই এসেছে নিজেদের নিয়মে। আমি বদলেছি, আমার চারপাশের মানুষেরা বদলেছে, পুরো পৃথিবীটা বদলেছে, এমনকি আমার স্বপ্নও বদলে গেছে। কোথায় পৌঁছাতে হবে, তা আমি সত্যি জানতাম না। আমি শুধু সেটাই করে গেছি, যা আমি জানতাম, আমি সবচেয়ে ভালো পারি।
তাহলে আজকে আমি নিজের মতো করে আমার গল্প বলব। আমার মতে, জীবনের মাপকাঠি হলো হৃদয়ের আর অভিজ্ঞতার পরিপূর্ণতা। এর বাইরে আর কিছুতেই তেমন কিছু যায়-আসে না। খ্যাতি, সাফল্য, সৌন্দর্য—এ সবকিছুর চেয়েও একটি পরিপূর্ণ হৃদয়ের মূল্য অনেক বেশি।
আমি একজন অভিনেতা। জর্জ বার্নস বলেছিলেন, ‘অভিনয়ের মূলে রয়েছে সততা’। শুদ্ধ সততার সঙ্গে যখন আমি কোনো চরিত্র রূপ দিতে পারি, তখন সেটাই হয় প্রকৃত অভিনয়। শুদ্ধতম অভিব্যক্তিগুলো আসে অভিনেতার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে।
এটা সত্যি যে সৃষ্টি যখন সবার সামনে উন্মোচিত হয়, তখনই তা স্রষ্টার থেকে আলাদা হয়ে জনগণের সম্পদ হয়ে যায়। এমন অনেক রাত গেছে, আমি হয়তো কোনো পুরস্কার পেয়ে প্রচণ্ড খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে বাড়ি ফিরেছি। আর তারপর আবিষ্কার করেছি কোনো সমালোচক লিখেছে যে আমাকে পুরস্কারের বদলে কাঁচা কলা দেওয়া উচিত ছিল! রাগে, ক্ষোভে তখন মনে হয়, কাঁচা কলা আর সমালোচক—এই দুটিরই চামড়া ছাড়িয়ে বাঁদরদের উপহার দেওয়া উচিত! এমন মুহূর্তগুলোতে আমি ক্ষণিকের জন্য হাল ছেড়ে দিই, কিন্তু তা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যখন তুমি ভেঙে পড়বে, যখন সারা পৃথিবী তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, তখন টিকে থাকার একটাই উপায়। আর তা হলো, তোমার প্রকৃত সত্তাকে আঁকড়ে ধরা। পৃথিবী তোমাকে না বুঝতে পারে, ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু অন্তত তোমার নিজেকে চিনতে হবে।
আমার বেলায় ব্যাপারটা একটা অদ্ভুত সমঝোতার মতো। আমি নিজের মতো অভিনয় করি, করতে চাই, আবার দর্শক আমার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করে, সেটাও মাথায় রাখতে হয়। আমাকে একই সঙ্গে আমার সেরা কাজটা দিতে হয়, আবার আমি যাদের জন্য কাজ করছি, তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে যাতে আমি বিচলিত না হয়ে পড়ি, এটাও খেয়াল রাখতে হয়। আমি চেষ্টা করি লাইনচ্যুত না হতে। ভেতরে যা-ই চলতে থাকুক না কেন, বাইরে আমি ঠিকই হাসছি, অটোগ্রাফ দিচ্ছি। কখনো কখনো মনে হয়, আমি একটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয় করে চলছি।
আমার দর্শক হচ্ছে পথচারীরা, যারা আমাকে হাততালি দিচ্ছে খানিকটা কৌতুকের বশে, খানিকটা দয়া করে আর খানিকটা তাচ্ছিল্যভরে। কিন্তু দর্শক যারাই হোক না কেন, আমি জানি আমার অন্তর্নিহিত সত্তা ঠিকই আমার অভিনয় দেখছে, ভালো কাজের জন্য বাহবা দিচ্ছে, আমার বোকামিগুলো দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। তাই আমি বলব, নিজেকে চিনতে শেখো, নিজের ওপর থেকে কখনো বিশ্বাস হারিয়ো না। নিজের জীবন নিয়ে কখনো হতাশ হয়ো না। জীবনের ওপর হতাশা আর বিতৃষ্ণা তোমার যত ক্ষতি করবে, তেমনটা আর কোনো কিছুই করতে পারবে না।
নিজের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখো।
সমালোচনা, নিন্দার ঊর্ধ্বে উঠে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। প্রচলিত নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পেয়ো না। একলা চলতে দ্বিধা কোরো না।
তোমাদের বয়সে আমি যা চাইতাম, আজ আমার সেই সব কিছু আছে। আমি সাফল্য পেয়েছি, খ্যাতি পেয়েছি, আমার যথেষ্ট সম্পদ আছে। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই আমাকে এতটা সুখ দেয়নি, যা দিয়েছে আমার সন্তানেরা। তোমরা এখনো বাবা-মা হওনি, কিন্তু তোমাদের বাবা-মা আছেন, যাঁরা তোমাদের অপরিসীম ভালোবাসেন। পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গেই তাঁদের ভালোবাসার কোনো তুলনা চলে না। খেয়াল করে দেখবে, সত্যিকারের সুখ এমন সব জিনিসে থাকে, যা কখনো গোনা যায় না। আর দেখ, এই ভালোবাসার বিনিময়ে তাঁরা তোমাদের কাছ থেকে কিছুই চান না। তোমরা তাঁদের অনুভূতিগুলোকে একটু শ্রদ্ধার চোখে দেখবে, এটাই তাঁদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। আমি দুটো অসম্ভব দুষ্টু শিশুর বাবা হয়ে বলছি।
সন্তান হিসেবে তোমরা যা-ই করো না কেন, যত বড় ভুলই করো না কেন, বাবা-মায়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর নেই। তোমাদের হয়তো মনে হতে পারে, তাঁরা বিরক্তিকর, একঘেয়ে, একগুঁয়ে। আমার সন্তানরাও আমায় তা-ই মনে করে। কিন্তু যদি কখনো কোনো ঝামেলায় পড়ো, তোমার মা-বাবাকেই তুমি সবচেয়ে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারো। আমি অনেক কম বয়সেই মা-বাবাকে হারিয়েছি, আমি জানি, তাঁদের আমি কতটা মিস করি। একটা কথা মনে রেখো, সাফল্য অনেক আকাঙ্ক্ষিত হলেও, বেশির ভাগ সময়ই তা আমাদের বড় কিছু শেখাতে পারে না। আর সেজন্যই সফল হওয়ার চাবিকাঠি-জাতীয় কোনো উপদেশ আমি দেব না। সত্য কথা হলো, আমি যতটা সফল হয়েছি, তা পেরেছি কারণ আমি ব্যর্থতা মানতে পারতাম না। সফল হওয়ার জন্য আমি কখনো এতটা প্রাণপণ চেষ্টা করিনি, যতটা না করেছি ব্যর্থতাকে এড়ানোর জন্য। আমি খুব সাধারণ এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। দারিদ্র্য কী জিনিস তা আমি খুব স্পষ্টভাবে চোখের সামনে দেখেছি।
আমি জানি, তার আসল রূপ কতখানি নিষ্ঠুর। যখন আমার বাবা-মা মারা যান, দারিদ্র্যের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আর একটি শব্দ যোগ হয়—ব্যর্থতা। আমি কোনোমতেই আর দরিদ্র থাকতে চাইনি। তাই যখন আমি প্রথম অভিনয় শুরু করি, তার সঙ্গে সৃজনশীলতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমি যেসব সিনেমা করতাম, তার বেশির ভাগই ছিল অন্যদের ফেলে দেওয়া চরিত্র, অথবা এমন কিছু, যাতে কেউই অভিনয় করতে রাজি হয়নি। আমি সেসব চরিত্রের প্রতিটিতে অভিনয় করেছি, শুধু একটা কারণে, যাতে আমাকে বেকার বসে না থাকতে হয়। এসব করতে করতেই একসময় আমি বড় অভিনেতা হলাম। সাফল্য তার নিজের নিয়মেই আমার জীবনে এসেছে, আমি আমার নিজের কাজটুকু করেছি মাত্র। তাই আমার মনে হয়, ব্যর্থতার যথেষ্ট ভয় না থাকলে, ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে সফল হওয়া কঠিন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছু কথা বলতে পারি।
আমি জানি, তার আসল রূপ কতখানি নিষ্ঠুর। যখন আমার বাবা-মা মারা যান, দারিদ্র্যের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আর একটি শব্দ যোগ হয়—ব্যর্থতা। আমি কোনোমতেই আর দরিদ্র থাকতে চাইনি। তাই যখন আমি প্রথম অভিনয় শুরু করি, তার সঙ্গে সৃজনশীলতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমি যেসব সিনেমা করতাম, তার বেশির ভাগই ছিল অন্যদের ফেলে দেওয়া চরিত্র, অথবা এমন কিছু, যাতে কেউই অভিনয় করতে রাজি হয়নি। আমি সেসব চরিত্রের প্রতিটিতে অভিনয় করেছি, শুধু একটা কারণে, যাতে আমাকে বেকার বসে না থাকতে হয়। এসব করতে করতেই একসময় আমি বড় অভিনেতা হলাম। সাফল্য তার নিজের নিয়মেই আমার জীবনে এসেছে, আমি আমার নিজের কাজটুকু করেছি মাত্র। তাই আমার মনে হয়, ব্যর্থতার যথেষ্ট ভয় না থাকলে, ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে সফল হওয়া কঠিন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছু কথা বলতে পারি।
১. ব্যর্থতা না থাকলে সফল হওয়া কঠিন। ব্যর্থ হওয়ার পর তোমার প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করে তুমি এরপর সফল হবে কি না। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, যদি একটা উপায় কাজ না করে, তাহলে অন্য কোনো একটা নিশ্চয়ই করবে। তাই আমি চেষ্টা করে যাই। ২. একবার ব্যর্থ হলে আমি আরও বেশি কাজ করা শুরু করি, আরও বেশি চেষ্টা করতে থাকি। বেশির ভাগ সময় এতেই সাফল্য এসে ধরা দেয়। ৩. যখন একের পর এক ব্যর্থতা আসতে থাকে, তখন বুঝতে পারি, আমি হয়তো আমার নিজের সত্তাকে ভুলে আমি যা নই তা হতে চাইছি। তখন আমি আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসি, যা আমার কাছে সত্যিকার অর্থেই গুরুত্ব বহন করে, আমি শুধু তাতেই মনোযোগ দিই। ৪. ব্যর্থতা তোমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে কে তোমার প্রকৃত বন্ধু আর কে নয়। সংকটের মুহূর্তগুলোতেই আমাদের সম্পর্কগুলোর পরীক্ষা হয়ে যায়। ৫. যখন আমি ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠি, তখন নিজেকে আরও ভালো করে চিনতে পারি। নিজের সম্ভাবনাগুলোকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করি। এভাবেই আমার আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। জীবনটা আসলে কতগুলো অর্জন, সাফল্য, যোগ্যতা আর পুরস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জীবনকে জানো, স্বপ্ন দেখো; ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়াও। তোমার যা আছে তার উপযুক্ত মূল্য দিতে শেখো। লোকের কথায় কান দিয়ো না আর ব্যর্থতাকে ভুলে যেয়ো না। নিষ্ঠুর হলেও সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ : অঞ্জলি সরকার