স্যাটেলাইটে বিশ্বে ৫৭ তম দেশ বাংলাদেশ

 

মহাকাশে বাংলাদেশি স্যাটেলাইট

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকাল ৪টা ১৪ মিনিটে ফ্লোরিডা রাজ্যের অরল্যান্ডোর কেনেডি স্পেস সেন্টারের কেপ কেনাভেরাল থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি ফ্যালকন-৯ রকেটের মাধ্যমে এটি উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ অনুসন্ধান ও মহাকাশ যান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স।
মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ রকেট ফ্যালকন-৯ মহাকাশে পৌঁছে যায় এবং তা নির্ধারিত প্যাডে ফেরত আসে। স্পেস এক্স জানিয়েছে, উৎক্ষেপণ সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল। ৩৩ মিনিট পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ দ্রাঘিমাংশে অবস্থান নেবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন লাগবে। স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রকল্প পরিচালক মো. মেজবাহুজ্জামান জানান, ফ্যালকন-৯ রকেটে চারটি অংশ রয়েছে। ওপরের অংশে থাকবে স্যাটেলাইট, তারপর অ্যাডাপটর। এরপর স্টেজ-২ এবং সবচেয়ে নিচে থাকে স্টেজ-১। তিনি বলেন, এ উৎক্ষপণ দেখতে হলে আগ্রহীদের উৎক্ষেপণ স্থানের তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিতে হবে। সাত মিনিটের কম সময় দেখা যাবে, তার পরপরই উচ্চগতির রকেট চলে যাবে দৃষ্টিসীমার বাইরে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রকেটের স্টেজ-১ খুলে নিচের দিকে নামতে থাকে, এরপর চালু হয় স্টেজ-২। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ পৃথিবীতে এলেও স্টেজ-২ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত স্যাটেলাইটকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশেই থেকে যায়।

পাঁচ হাজার কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধন নিয়ে ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ গঠন করা হয়েছে। এই কোম্পানি স্যাটেলাইটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন সংস্থার (আইটিইউ) ‘রিকগনিশন অফ এক্সিলেন্স’ পুরস্কারও পেয়েছে। বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়, সেই অর্থ সাশ্রয় হবে। বিদেশে ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনাও সম্ভব হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ উৎক্ষেপণের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বোধন ঘোষণার পূর্বে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানান। বিশেষ করে কক্ষপথ ভাড়া দেয়ার জন্য রাশিয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এর আগে ৬ বার তারিখ পরিবর্তনের পর বৃহস্পতিবার মাত্র ৪২ সেকেন্ডে আগে উৎক্ষেপণ বাতিল হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের। রকেট ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত থাকলেও গ্রাউন্ড সিস্টেমে প্রস্তুত না থাকায় কম্পিউটার সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎক্ষেপণ বন্ধ করে দেয়। তবে উৎক্ষেপণের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল সর্বত্র। তবে সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে সেই অবস্থার অবসান হলো। অন্যদিকে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইটের অধিকারী দেশ হলো বাংলাদেশ।

উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, ৩০ সদস্যের বাংলাদেশের দলের নেতা তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ও ইমরান আহমেদ, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. জিয়াউদ্দিন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসানসহ সহস্রাধিক বাংলাদেশি। দুই শতাধিক ব্যক্তির স্পেস এক্স-এর কেনেডি স্পেস সেন্টারে প্রবেশাধিকার থাকলেও অন্যরা বিভিন্ন স্থান থেকে উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে দলের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী বিভিন্ন স্থান থেকে উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করেন। বিভিন্ন রাজ্য থেকে নেতা-কর্মীরা আগে থেকেই ফ্লোরিডা যান উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করতে।
বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান ড. শাহাজান মাহমুদ জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যেমন নির্ভরতা কমবে অন্য দেশের ওপর, তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। স্পেস এক্স-এর উৎক্ষেপণযান বা রকেট ফ্যালকন-৯ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে মহাকাশে ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত অরবিট প্লটে স্থাপন করবে। আর স্যাটেলাইটের সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে প্রায় এক মাস।

ফ্রান্সের কান টুলুজ ফ্যাসিলিটিতে নির্মিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ইতিমধ্যে ফ্রান্স থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় কার্গো বিমানে করে উৎক্ষেপণস্থল ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর ক্যাপ ক্যানাভেরালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা স্যাটেলাইট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থেলেস এলেনিয়া স্পেস বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকার মত। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট এক হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা বিডার্স ফাইনান্সিং-এর মাধ্যমে ব্যয় সংকুলান হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে প্রাথমিক এবং রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র দ্বিতীয় গ্রাউন্ড স্টেশনের নির্মাণ কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর এটি পরিচালনা, সফল ব্যবহার ও বাণিজ্যিক কার্যত্রম সম্পাদনের জন্য ইতিমধ্যে সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কোম্পানিতে কারিগরী লোকবল নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট সংস্থা বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ খাতে ব্যয় করছে বছরে ১৪ মিলিয়ন ডলার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কার্যক্রম শুরু হলে এই বিপুল অর্থ দেশেই থেকে যাবে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এরমধ্যে ২০টি দেশে ব্যবহারের জন্য এবং ২০টি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মূদ্রা আয় হবে। এছাড়া নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকায় বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার অবসান হবে। টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-গবেষণা, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।
এদিকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ উপলক্ষে অরল্যান্ডোর বিভিন্ন স্থানে উৎসব করে বাংলাদেশিরা। তারা আতশবাজি জ্বালিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে।

জাতির গৌরবময় এ মুহূর্তটির সাক্ষী হতে অরল্যান্ডো কেনেডি স্পেস সেন্টারে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সমাগম ঘটে, উৎক্ষেপণের তারিখ পিছিয়ে গেলেও উৎসব-আমেজে তেমন ভাটা পড়েনি। তবে একদিন পিছিয়ে যাওয়ায় সবাইকে ফ্লাইটের টিকিট

পরিবর্তনসহ হোটেল-মোটেলের বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়েছে। এর আগেও কয়েক দফায় অনেক প্রবাসীর ফ্লাইটের টিকিট বাতিল হয়েছে।

জেনে নেই আরো কিছু তথ্যঃ
বাংলাদেশ থেকে পরিচালিতে ইন্টারন্যাশনাল  নিউজঃ স্যাট নিউজ   এর  তথ্যমতে

  • মহাকাশে প্রায় ৫০টির উপর দেশের দুই হাজারের উপর স্যাটেলাইট বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-আবহাওয়া স্যাটেলাইট, পর্যবেক্ষক স্যাটেলাইট, ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট ইত্যাদি। তবে বিএস-ওয়ান হল যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট।
  • টিভি চ্যানেলগুলোর স্যাটেলাইট সেবা নিশ্চিত করাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রধান কাজ। এর সাহায্যে চালু করা যাবে ডিটিএইচ বা ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস।
  • যেসব জায়গায় অপটিক কেবল বা সাবমেরিন কেবল পৌছায় নি সেসব জায়গায় এ স্যাটেলাইটের সাহায্যে নিশ্চিত হতে পারে ইন্টারনেট সংযোগ।
  • বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার কক্ষপথে। এর ফুটপ্রিন্ট বা কভারেজ হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • শক্তিশালী কেইউ ও সি ব্যান্ডের মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালো কাভার করবে পুরো বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া।
  • ১৫ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে অরবিটাল স্লট কেনা হয়েছে। তবে বিএস ওয়ানের স্থায়িত্ব হতে পারে ১৮ বছর পর্যন্ত।
  • ৩.৭ টন ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটির ডিজাইন এবং তৈরি করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস। আর যে রকেট এটাকে মহাকাশে নিয়ে যাচ্ছে সেটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্স।
  • শুরুতে বাজেট ধরা হয় ২৯৬৭.৯৫ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ২৭৬৫ কোটি টাকায় এ পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হল। এর মধ্যে ১৩১৫ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার আর বাকিটা বিদেশি অর্থায়ন।
  • প্রথম ৩ বছর থ্যালাস অ্যালেনিয়ার সহায়তায় এটির দেখভাল করবে বাংলাদেশ। পরে পুরোপুরি বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের হাতেই গাজীপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়া আর্থ স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে এটি।

সুত্রঃ স্যাট একাডেমি

You may also like...

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.