“অালফ্রেড নোবেল” মহান হৃদয়ের বিজ্ঞানীর জীবনের গল্প

অালফ্রেড নোবেল ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, অাবিষ্কারক, রসায়নবিদ এবং দার্শনিক। তার পুরো নাম অালফ্রেড বের্নহার্ড নোবেল। ১৮৬৭ সালে তিনি যুগান্তকারী ডিনামাইট অাবিষ্কার করেন। অালফ্রেড নোবেলকে বলা নোবেল পুরষ্কারের জনক। প্রচুর সম্পদশালী এই মহান ব্যক্তি মৃত্যুর অাগে সম্পত্তির ৯৪ শতাংশ উইল করে যান নোবেল পুরস্কারের জন্য। বিশ্বের সেরা এই পুরস্কার ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয়। শান্তি প্রিয় অালফ্রেড নোবেল সম্পর্কে অালোচনা করা হবে।

সংক্ষিপ্ত পরিচয়

অালফ্রেড নোবেল ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ইমানুল নোবেল। মা ক্যারোলিনা অান্দ্রিয়েতি। অাট ভাই বোনের মধ্যে নোবেল ছিল তৃতীয়। নোবেলের বাবা ছিলেন একজন স্থপতি এবং উদ্ভাবক। ১৮৭২ সালে নোবেলের বাবা ইমানুলের মৃত্যু হয়। অার মা অান্দ্রিয়েতি ১৮৮৯ সালে মারা যান। অালফ্রেড নোবেল ছিলেন অবিবাহিত। ১৮৪২ সালে অালফ্রেড নোবেলের বাবা ইমানুল নোবেল পরিবারকে সেন্ট পিটাসবার্গে নিয়ে অাসেন স্টকহোম থেকে।

পড়াশোনা

অালফ্রেড নোবেল স্টকহোমের সেন্ট জ্যাকব স্কুলে পড়াশোনা শুর করেন ১৮৪১ সালে। পিটাসবার্গে চলে যাবার পর প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়েন। তারপর তিনি নিকোলাই জেনিনের কাছে রসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ১৮৫০ সালে তিনি প্যারিসে যান। রসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা করেন যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর তিনি বিষ্ফোরক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। অালফ্রেড নোবেল ছিলেন অনেকটা স্বশিক্ষিত। তিনি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মানি, সুইডিশ এবং রুশ ভাষা জানতেন।

কর্মজীবন

স্টকহোম থেকে পিটাসবার্গে যাওয়ার পর নোবেলের বাবা ইমানুল বিষ্ফোরক পদার্থের ব্যবসা শুরু করেন। শুরুতে তিনি তার বাবার কারখানায় কাজ  অালফ্রেড নোবেল ছোটকাল থেকেই পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। তিনি কাজের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে। ১৮৫৩-১৮৫৬ সালে ক্রিমিয়ান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাদের কোম্পানীর অায় বেড়ে যায়।

যুদ্ধ শেষ হবার তাদের কোম্পানীর লোকসান শুরু হয়। অালফ্রেড নোবেল চিন্তায় পড়ে যান। তিনি নতুন কিছু তৈরি করার কথা ভাবতে থাকেন। ১৮৬২ সালে তিনি নাইট্রোগ্লসারিন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৮৬৩ সালে তিনি নাইট্রোগ্লিসারিন নিজের নামপ প্যাটেন্ট করেন। তারপর তিনি স্টকহোমে চলে অাসেন। স্টকহোমের হেলেনবোর্গে ‘নাইট্রোগ্লিসারিন এবি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। জার্মানির হামবার্গে নতুন একটি কোম্পানি চালু করেন। যার নাম ছিল ‘অালফ্রেড নোবেল অ্যান্ড কোম্পানি।’

১৮৬৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ব্লাস্টিং অয়েল কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি ডিনামাইট অাবিষ্কার করেন। ডিনামাইট বিক্রি করে তিনি প্রচুর অর্থ অায় করেন।

ডিনামাইট অাবিষ্কার

ডিনামাইট এক ধরনের বিষ্ফোরক যা নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন শোষক পদার্থ দিয়ে নাইট্রোগ্লাসারিনকে শোষণ করিয়ে ডিনামাইট তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। পাথর উত্তোলন এবং নির্মান কারখানায় ব্যবহৃত হয় ডিনামাইট। অালফ্রেড নোবেল ১৮৬৭ সালে ডিনামাইট অাবিষ্কার করেন।

পরবর্তীতে তিনি এর প্যাটেন্ট লাভ করেন। সক্টল্যান্ডের অার্ডিয়ারে ১৮৭১ সালে তিনি ব্রিটিশ ডায়নামাইট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এক সময় এই কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘নোবেল’স এক্সপ্লোসিভ কোম্পানি’। তার অাবিষ্কৃত বিষ্ফোরক বিশ্বের নানান দেশে বিক্রি করতেন। তখন এর চাহিদা ছিল প্রচুর। ডিনামাইট ৯০টি কারখানায় তৈরি হতো।

ডিনামাইটের ডায়াগ্রাম

ডিনামাইট অাবিষ্কারের পূর্বে অালফ্রেড নোবেল নাইট্রোগ্লিসারিন অাবিষ্কার করেন। এসব বিষ্ফোরক পদার্থ অাবিষ্কারের পেছনে অালফ্রেড নোবেলের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। অার তা হচ্ছে, সব ধরনের যুদ্ধের অবসান করা। তিনি বিশ্বাস করতেন নাইট্রোগ্লিসারিন এবং ডিনামাইট ব্যবহার বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে লাগবে। তিনি মনে করতেন দুটি দেশের সেনাবাহিনী মুর্হতেই একে অপরকে ধ্বংস করারর ক্ষমতা অর্জন করবে সেদিন পৃথিবীর সভ্য জাতিগুলো যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। অালফ্রেড নোবেলের এমন ভাবনা ভাবনাই রয়ে গেল। মানুষ তার অাবিষ্কার গ্রহণ করল ভিন্ন ভাবে।অালফ্রেড নোবেলের ৩৫৫ টি প্যাটেন্ট ছিল। নাইট্রোগ্লিসারিন এবং ডিনামাইট ছাড়াও ১৮৮৭ সালে ‘ব্যালিস্টিক’ নামে এক ধরণের বিষ্ফোরক পাউডার অাবিষ্কার করেন।

নোবেল পুরস্কারের জনক

অালফ্রেড নোবেল হলেন নোবেল পুরস্কারের জনক। তিনি ছিলেন প্রচুর সম্পদশালী। ১৮৯৫ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার সম্পত্তি উইল করেন। সম্পদের ৯৪ শতাংশ উইল করেন। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা।১৯০০ সালের ২৯ জুন নোবেল ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। এই ফাউন্ডেশন থেকেই প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রথম নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯০১ সালে। গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মানব কল্যাণমূলক কর্মকান্ডের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

যে ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার দেয়া হয় তা হলো বিশ্বশান্তি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য এবং অর্থনীতি। ১৯৪০-১৯৪২ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় নোবেল পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল।পুরস্কার হিসেবে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। প্রথম নোবেল পুরষ্কার যাদের দেওয়া হয় তারা হলেন পদার্থবিজ্ঞানে; উইলহেম রন্টজেন, রসায়নে; ভ্যান্ট হপ, চিকিৎসা শাস্ত্রে; এমিল ভন সাহিত্যে; সুলি প্রুধম, শান্তিতে; হেনরি ডুনান্ট এবং ফ্রেডারিক পাসি,অর্থনীতিতে ; রেগনার ফ্রিস ও জন টিনবার্গেন। নোবেল বিজয়ীদেরকে বলা হয় ‘নোবেল লরিয়েট’। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান ড. মুহম্মদ ইউনুস।

মৃত্যু

অালফ্রেড নোবেল ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

You may also like...

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.