সম্ভালা কাল্পনিক গল্প

‘শাম্ভালা’ পৃথিবীর বুকে রহস্যময় এক অঞ্চল। অনেকের ধারণা শাম্ভালা হচ্ছে পৌরাণিক এবং ঐন্দ্রজালিক রহস্যে ঘেরা এক দেশ। পৃথিবীর অনেক মানুষ শম্ভালা সম্পর্কে জানেনা। সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত ‘শাম্ভালা’, যার অর্থ ‘শান্তিময় স্থান’। এশিয়ার মানুষের কাছে এটি শাম্ভালা, শাম্বাল্লা বা সাংগ্রিলা নামে সর্বাধিক পরিচিত। অঞ্চলটিকে আগার্থা নামেও ডাকা হয়ে হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, যেমন- প্রাচীন কালচক্র তন্ত্রে কিংবা তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের জ্যাংজুং সংস্কৃতির পুরনো গ্রন্থেও এই শহরের নাম পাওয়া যায়।

কিংবদন্তি
তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের জ্যাংজুং সংস্কৃতির প্রাচীন পুঁথি হতে জানা যায়, তিব্বতের বরফে ঢাকা পাহাড়গুলোর আড়ালে রহস্যময় শাম্ভালা নামক রাজ্যটি অবস্থিত, যেখানে জ্ঞানী রাজারা বৌদ্ধধর্মের গূঢ় শিক্ষাগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছেন। পৃথিবী যখন অন্যায়-অবিচার, লোভ-লালসা আর যুদ্ধ-বিগ্রহে জর্জরিত হয়ে পড়বে, ঠিক তখনই শাম্ভালা রাজ্যের রাজা এক বিরাট বাহিনী নিয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করবেন।

তিব্বতের সিরা মনেস্ট্রিতে রাখা প্রাচীন কালচক্র তন্ত্রের নমুনা;
আবার প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, শাম্ভালার রাজা সুচন্দ্র একদা ভারতে এসে শাক্যমুনি বুদ্ধের কাছ থেকে কালচক্র তন্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধের নির্দেশ অনুযায়ী, তিনি বৌদ্ধধর্মের এই গোপন শিক্ষা শাম্ভালা রাজ্যে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করে চলেছেন। আবার হিন্দু ধর্মের বিষ্ণুপুরাণেও উল্লেখ রয়েছে, বিষ্ণুর অবতার কল্কির জন্মস্থান এই শাম্ভালা।

বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণুর অবতার কল্কির জন্মস্থান এই শাম্ভালা |

রহস্যময় এক আধ্যাত্মিক স্থান
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, শাম্ভালা পৃথিবীর বুকে এমন এক স্থান, যেখানে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ আত্মার ব্যক্তিরা বাস করে থাকেন। এটি স্বর্গীয় এক স্থান। প্রেম, ভালোবাসা আর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত এই দেশ। এখানে কোনো কষ্ট নেই, জরা নেই। বয়স এখানে চিরদিনের মতো থমকে আছে। এই দেশে শুধুই আনন্দ, কোনো দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই। এখানকার অধিবাসীরা নানা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। প্রযুক্তি, শিল্প, বিজ্ঞান- যেকোনো বিষয়ের জ্ঞানে তারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

শিল্পীর চোখে শাম্ভালা রাজ্যের চিত্ররূপ|
শাম্ভালা নিয়ে বৌদ্ধধর্মে এক ভবিষ্যদ্বাণী প্রচলিত রয়েছে, এই কল্পনগরীতে নাকি বত্রিশজন রাজা রয়েছেন। প্রত্যেক রাজা একশো বছর ধরে রাজ্যটি শাসনের দায়িত্বে থাকবেন। যখন তাদের শাসনকালের অবসান ঘটবে, ঠিক তখনই বাইরের পৃথিবী জুড়ে নানা অরাজকতার সৃষ্টি হবে। পাপে পূর্ণ হয়ে ‍উঠবে এই ধরিত্রী। মানুষের লোভ-লালসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা আকাশ ছোঁবে। যুদ্ধ, নৃশংসতা আর নিষ্ঠুরতায় এই পৃথিবীর মাটি রক্তিম বর্ণ ধারণ করবে।

পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর এবং অন্ধকার জগতের মানুষরা এক শয়তান রাজার অধীনে একজোট হবে। আর ঠিক তখনই এই পাপিষ্ঠদের বিনাশ এবং পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে বরফে ঢাকা পাহাড়ের কুয়াশা সরে গিয়ে শাম্ভালা আত্মপ্রকাশ করবে। যখন সেই শয়তান রাজার সৈন্যবাহিনী শাম্ভালার উপর আক্রমণ চালাবে, বত্রিশতম শাম্ভালার রাজা রুদ্রন জাঁপো ভয়াবহ যুদ্ধে তাদের হারিয়ে দেবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সেই রাজা আর তার অনুচরেরা।

শিল্পী নিকোলাস রোয়েরিকের চিত্রে শাম্ভালার রাজা রুদ্রন জাঁপো|

তবে কালচক্রের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষার একধরনের বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধধর্ম কোনো সহিংসতা পছন্দ করে না। তাই কালচক্রে যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিতই মনে করেন কালচক্রে তা প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কালচক্রে যে রিপুগুলোর কারণে মানুষ তার মানবিক গুণাবলী হারিয়ে ফেলে, সেই রিপুগুলো দমনের কথাই বলা হয়েছে।

পশ্চিমাদের কাছে শাম্ভালা এক মুগ্ধতার নাম
পশ্চিমাদের চোখে শাম্ভালা নিয়ে রয়েছে অপার মুগ্ধতা। কালচক্রকে ঘিরে রচিত হওয়া নানা গল্পগাথা পশ্চিমা বিশ্বের গবেষক, পণ্ডিতদেরকে বারবার মোহিত করেছে। এছাড়া তিব্বত দেশটি নিষিদ্ধ ভূমি হওয়ায় পশ্চিমাদের কাছে তাই শাম্ভালা হয়ে উঠেছে কুয়াশাঘেরা রহস্যময় এক স্থান। তাদের ধারণা, শাম্ভালার সন্ধান পাওয়া গেলে পৃথিবীর অনেক অজানা তথ্যই জানা সম্ভব হবে। জোয়াও ক্যাবরাল এবং এস্তেভো ক্যাসেলা নামের দুই ক্যাথলিক মিশনারির কাছ থেকে পশ্চিমা বিশ্ব প্রথম শাম্ভালা সম্পর্কে জানতে পারেন। কিন্তু তারা প্রথমদিকে মনে করেছিলেন, চীনের আরেকটি নামই হচ্ছে শাম্ভালা।

পশ্চিমাদের কাছে শাম্ভালা এক অপার মুগ্ধতার নাম|

কিন্তু ১৬২৭ সালে তারা যখন তাসিলহুনপোয় যান, সেখানকার মঠের প্রধান পঞ্চান লামার সাথে সাক্ষাতের পর তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। ১৮৩৩ সালে সান্দর কোরোসি সিসমা নামের এক হাঙ্গেরিয়ান পণ্ডিত উত্তরের ৪৫ ডিগ্রি থেকে ৫০ ডিগ্রি অক্ষাংশের মধ্যে এই রহস্যময় অঞ্চলটির অবস্থান আছে বলে জানান। উনবিংশ শতাব্দীতে, থিওসফিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা হেলেনা পি ব্লাভ্যাস্কি শাম্ভলাকে পৌরাণিক রাজ্য হিসেবে অভিহিত করেন।

কুখ্যাত সেনানায়ক অ্যাডলফ হিটলার অতীন্দ্রীয়বাদে খুব বিশ্বাস করতেন। তিনিও শাম্ভালার খ্যাতি সম্পর্কে বেশ অবগত ছিলেন। দেশটি সম্পর্কে তিনি এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, শেন হেডিন নামে এক বিখ্যাত অভিযাত্রীর সাহায্যে অনেকবার তিব্বতে এই শহরের সন্ধানে নাৎসি বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রহস্যময় রাজ্যের খোঁজ মেলেনি।

কোথায় রয়েছে এমন একটি দেশ?

You may also like...

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.